ঘরে বসেই জমির খাজনা পরিশোধ করুন অনলাইনে!
বলহার গ্রামের সহজ সরল কৃষক রেণু মিয়া। জমির খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে প্রতি বছরই তাকে ঝামেলায় পড়তে হতো। খাজনা পরিশোধ এর জটিলতা নিয়ে পড়তেন মহা ভোগান্তিতে। তবে এক বাল্যবন্ধু মারফত তিনি জানতে পারেন, এখন জমির খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর খুব সহজেই অনলাইন পদ্ধতিতে পরিশোধ করা যায়।
আজকের এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করবো কিভাবে রেণু মিয়ার মতো আপনিও ঘরে বসেই জমির খাজনা পরিশোধ করতে পারবেন অনলাইনে। তবে চলুন সময় নষ্ট না করে শুরু করা যাকঃ
কোনো জমি ভোগ দখলের সুবিধা গ্রহণের জন্য সরকারকে প্রতি শতাংশ জমির জন্য প্রতি বছর যে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা প্রদান করতে হয় তাকেই ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা বলে।
খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর হচ্ছে জমি ব্যবহারের বিপরীতে সরকারের নিকট বাৎসরিক প্রদেয় কর। ২৫ বিঘার উর্দ্ধের কোন কৃষি জমি কিংবা যে কোন পরিমাণ জমি যা আবাসিক বা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হয় তার জন্য জমির মালিককে সরকারের নিকট নির্ধারিত হারে প্রতি বৎসর এই কর প্রদান করতে হয়।
সরকার নির্ধারিত অন্যান্য করের মতই এটিও একটি কর এবং জমির খাজনা জমির মালিকের নিকট হতে সরকারের একটি বাৎসরিক পাওনা স্বরূপ কাজ করে থাকে। যদি কোন ব্যক্তি ৩ বছরের বেশি কোন জমির খাজনা না দেয় তবে ‘সরকারি দাবি আদায় আইন ১৯১৩’ এর ৪, ৭, ৪৬ক ধারা মোতাবেক ধারাবাহিক নোটিসের পরে সরকার উক্ত জমির নিলাম ইশতেহার করে উক্ত অর্থ আদায় করতে পারবে অথবা সরকারি জমি হিসেবে খাস খতিয়ানেও অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। অর্থাৎ, আপনার জমির মালিকানা বজায় রাখতে এবং সঠিক ভাবে ভোগ দখল করতে সরকার দ্বারা নির্ধারিত খাজনা সময়মত পরিশোধ করতে হবে।
অনলাইনে জমির খাজনা পরিশোধ করার কারনঃ
আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কেন অনলাইনে জমির খাজনা পরিশোধ করবেন। আসুন জেনে নেই কেন অনলাইন পদ্ধতিতে খাজনা পরিশোধ করবেন-
প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে জমির খাজনা পরিশোধের প্রক্রিয়া এখন অনেক সহজ ও দ্রুত হয়েছে। পূর্বে খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর প্রধানত নগদে পরিশোধ করা হতো, পাশাপাশি অনলাইনেও পরিশোধ করা যেত। কিন্তু বর্তমান সময়ে সরকার কর্তৃক ‘ক্যাশলেস ভূমি উন্নয়ন কর ব্যবস্থা’ চালু করেছে যার ফলে খাজনা নগদ পরিশোধের সুযোগ আর থাকছে না। নির্ধারিত ওয়েবসাইটে গিয়ে অনলাইনে জমির খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ বাধ্যতামূলক।
এছাড়াও অনলাইনে জমির খাজনা দেওয়ার আরও কিছু সুবিধা রয়েছে, যা নিচে আলোচনা করা হলোঃ
- তথ্যের নিরাপত্তা: অনলাইনে খাজনা পরিশোধ করলে তথ্য হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না যার ফলে সব তথ্য সুরক্ষিত থাকে।
- সহজ ও দ্রুত: অনলাইন পদ্ধতিতে কয়েকটি সহজ ধাপ অনুসরণ করে দ্রুত খাজনা পরিশোধ করা যায়।
- সময়ের স্বল্পতা: সরাসরি অফিসে না গিয়ে ঘরে বসেই জমির খাজনা পরিশোধ করা যায়, যার ফলে দীর্ঘ লাইনে দারিয়ে থাকার সময় বেঁচে যায়।
আপনার জমির খাজনা পরিশোধ করার জন্য অবশ্যই নিবন্ধন করতে হবে। ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক সহজে ভূমিসংক্রান্ত সেবা দিতে এরই মধ্যে ভূমি উন্নয়ন কর ডিজিটাল সফটওয়্যার ব্যবস্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। উপজেলা ভূমি অফিস, ইউনিয়ন ভূমি অফিস, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে যোগাযোগ করে নিম্নলিখিত কাগজপত্র দিয়ে জমির হোল্ডিং রেজিস্ট্রেশন বা মালিকানার নিবন্ধন করা যাবে।
খাজনা পরিশোধে নিবন্ধন করার জন্য যা যা লাগবেঃ
- জমির রেকর্ড/খতিয়ানের তথ্য।
- পূর্ববর্তী দাখিলার কপি
- আপনার জাতীয় পরিচয়পত্রের (NID) নম্বর।
- পাসপোর্ট সাইজের ছবি ১ কপি
- সক্রিয় মোবাইল নম্বর।
সশরীরে হাজির না হয়ে জমির মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে আরও দুইটি উপায়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করা যায়। উপায়গুলো হলোঃ
১. ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনলাইন পোর্টালে (www.land.gov.bd) অথবা (www.ldtax.gov.bd) জাতীয় পরিপয়পত্র বা এনআইডি নম্বর, মোবাইল ফোন নম্বর ও জন্মতারিখ দিয়ে নিবন্ধন করা যাবে।
২. কল সেন্টার নম্বরে (১৬১২২ অথবা ৩৩৩) ফোন করে জাতীয় পরিপয়পত্র বা এনআইডি নম্বর, জন্মতারিখ ও জমির তথ্য দিয়ে নিবন্ধন করা যাবে।
নিবন্ধন কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পন্ন করার পর এবার চলুন জেনে নেই জমির খাজনা অনলাইনে পরিশোধ করার জন্য কি কি প্রয়োজনঃ
- জমির খতিয়ানের তথ্য।
- আপনার জাতীয় পরিচয়পত্রের (NID) নম্বর।
- সক্রিয় মোবাইল নম্বর।
- একটি সক্রিয় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) অ্যাকাউন্ট (যেমন: বিকাশ, রকেট)।
- ইন্টারনেট সংযোগ।
অনলাইনে জমির খাজনা পরিশোধ করার জন্য আপনাকে কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হবে। নিম্নে জমির খাজনা অনলাইনে পরিশোধ এর ধাপসমূহ বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হলোঃ
হোল্ডিং ট্র্যাকিংঃ
- সর্বপ্রথম আপনাকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে (https://land.gov.bd/) প্রবেশ করে “নাগরিক কর্নার” লিংকটি তে ক্লিক করতে হবে;
- এরপর ‘অনলাইন ভূমি উন্নয়ন কর’ (হোল্ডিং ট্র্যাকিং) এই বাটনটি তে ক্লিক করলে একটি ফরম আসবে যেখানে, আপনাকে নিজের বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও মৌজা নির্বাচন করতে হবে;
- এরপর আপনাকে হোল্ডিং নম্বর [যে খতিয়ান, দাগ ও জমির ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) পরিশোধ করতে চান] লিখে ‘অনুসন্ধান করুন’ বাটনে ক্লিক করতে হবে;
- বাটনটি তে ক্লিক করার পর আপনার কাঙ্খিত হোল্ডিং ও ভূমি উন্নয়ন করের তথ্য দেখতে পাবেন। তাছাড়া ‘বিস্তারিত বাটন’ এ ক্লিক করলে উক্ত হোল্ডিং এর বিস্তারিত তথ্য আপনি দেখতে পাবেন।
ধার্যকৃত ভূমি উন্নয়ন করের ওপর আপত্তি দাখিলঃ
- এই পর্যায়ে আপনাকে প্রদর্শিত হোল্ডিং এর ওপর কোনো আপত্তি থাকলে ‘আপত্তি দাখিল’ বাটনে ক্লিক করতে হবে;
- বাটনে ক্লিক করার পর একটি ফরম প্রদান করবে। আপনাকে এই ফরমটি পূরণ করে ফরমের ‘হ্যাঁ’ বাটনে ক্লিক করতে হবে এবং ফরমটি দাখিল করতে হবে;
- এই পদ্ধতিতে আপনার ধার্যকৃত ভূমি উন্নয়ন করের ওপর আপত্তি নিষ্পত্তি করা হবে।
অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর/জমির খাজনা প্রদান পদ্ধতিঃ
একজন নাগরিক চাইলে সোনালী ব্যাংক, কার্ড এবং মোবাইল বাংকিং এই তিনটি মাধ্যমের যেকোনো একটি উপায় অবলম্বন করে খাজনা অনলাইনে পরিশোধ করতে পারেন।
অনলাইনে জমির খাজনা প্রদানের জন্য প্রথমে আপনাকে ‘অনলাইন পেমেন্ট’ বাটনে ক্লিক করতে হবে; এরপর অনলাইন পেমেন্ট মাধ্যম নির্বাচন করতে হবে। আরনার সুবিধা মতো আপনি চাইলে ই-চালান অথবা সোনালী পেমেন্ট যেকোনো একটি নিরবাছন করতে পারেন। তারপর আপনাকে পেমেন্ট মেথড নির্বাচন করতে হবে। আপনি সোনালী ব্যাংক, কার্ড, মোবাই্ল ব্যাংকিং এর যে কোন ও একটি মেথড নির্বাচন করতে পারবেন।
কার্ডের মাধ্যমে জমির খাজনা পরিশোধের পদ্ধতিঃ
- আপনি যদি কার্ডের মাধ্যমে পেমেন্ট করতে চান সেক্ষেত্রে কার্ড অপশন এর পাশে উল্লিখিত যে কোনো একটি কার্ড নির্বাচন করতে হবে। যেমন- ভিসা কার্ড/ক্রেডিট কার্ড/মাস্টার কার্ড/কিউ ক্যাশ।
- আপনি যে কার্ড টি নির্বাচন করবেন সেখানে আপনার নাম, নাম্বার, কার্ড Expire Date, Security Code ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য পূরণ করে ‘Pay Now’ বাটনে ক্লিক করতে হবে।
- এরপর আপণী যে ব্যাংক থেকে পেমেন্ট করতে চান সেখান থেকে একটি ‘One Time Password’ (OTP) আসবে। কোডটি নির্দিষ্ট স্থানে পূরণ করে ‘Submit’ বাটনে ক্লিক করতে হবে।
- ‘Submit’ বাটনে ক্লিক করার মাধ্যমে আপনি আপনার জমির খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে পাবেন।
- পেমেন্ট সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে ‘অনলাইন দাখিলা’ আপনার ব্রাউজারে প্রদর্শিত হবে, যা আপনি ডাউনলোড অথবা প্রিন্ট করে রাখতে পারেন। এটি আপনার জমির খাজনা পরিশোধ এর প্রমাণস্বরূপ কাজ করবে।
মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে ভূমি উন্নয়ন কর পেমেন্ট করার পদ্ধতিঃ
মোবাইল ব্যাংকিং এ্যাপ হিসেবে আমরা ‘bKash’ বিবেচনায় নিয়ে পেমেন্ট পদ্ধতি আলোচনা করবো।
- প্রথমে পেমেন্ট অপশনে মোবাইল বাংকিং ‘bKash’ নির্বাচন করলে ‘Pay with bKash’ নামের একটি অপশন আসবে। এরপর যে মোবাইল নাম্বারে আপনার ‘bKash’ একাউন্ট খলা আছে সেটি শূন্যস্থানে লিখে ‘Confirm’ বাটনে ক্লিক করতে হবে।
- এরপর আপনার মোবাইলে bKash থেকে ভেরিফিকেশন কোড আসবে এবং আপনাকে উক্ত কোডটি প্রদান করে ‘Confirm’ বাটনে ক্লিক করতে হবে।
- অতঃপর আপনার bKash এর পিন কোডটি প্রদান করে ‘Confirm’ বাটনে ক্লিক করতে হবে। এভাবে পেমেন্ট প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
- পেমেন্ট সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে ‘অনলাইন দাখিলা’ আপনার ব্রাউজারে প্রদর্শিত হবে, যা আপনি ডাউনলোড অথবা প্রিন্ট করে রাখতে পারেন। এটি আপনার জমির খাজনা পরিশোধ এর প্রমাণস্বরূপ কাজ করবে।
‘bKash’ ব্যতীত অন্যান্য মোবাইল মোবাইল ব্যাংকিং এ্যাপ (যেমন- নগদ, রকেট, উপায়) ব্যবহার করেও অনলাইনে জমির খাজনা প্রদান করা যায়। এসকল মোবাইল মোবাইল ব্যাংকিং এ্যাপ এর মাধ্যমে জমির খাজনা পরিশোধ পদ্ধতিও প্রায় অনুরূপ। এছাড়াও, হোল্ডিং মালিকগণ Union Digital Centre (UDC)/ কোন কম্পিউটারের দোকান/ যেকোনো কম্পিউটার/ স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেও জমির খাজনা অনলাইনে পরিশোধ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রমাণস্বরূপ অবশ্যই আপনাকে অনলাইন দাখিলা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হবে।
প্রায় প্রতিটি বিষয়েরই কিছু সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ থাকে। এখন আমরা অনলাইনে জমির খাজনা পরিশোধের সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আলোচনা করবঃ
সুবিধা:
- তাৎক্ষনিক খাজনা পরিশোধ।
- সিস্টেমে সব তথ্য সংরক্ষিত থাকে, তাই হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেই।
- অফিসে না গিয়ে খাজনা পরিশোধ করার সুবিধা।
চ্যালেঞ্জ:
- ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলে বা সিস্টেমের কোন সমস্যা হলে খাজনা পরিশোধে জটিলতা হতে পারে।
- তথ্য সঠিকভাবে না দিলে পেমেন্ট ব্যর্থ হতে পারে।